সোনাদিয়া দ্বীপে বননাশে পর্যটন বিপর্যয়

কক্সবাজারের মহেশখালীর উপকূলে অবস্থিত বিচ্ছিন্ন দ্বীপ সোনাদিয়া—প্যারাবনের সবুজ ছায়া, লাল কাঁকড়ার চলাচল, বৈচিত্র্যময় সামুদ্রিক প্রাণী আর শান্ত সমুদ্রসৈকতের জন্য বহুদিন ধরেই পর্যটকের প্রিয় স্থান। স্থানীয়দের ভাষায়, একসময় প্রচুর মাছধরা ও শুঁটকি উৎপাদনের কারণে দ্বীপটি ছিল ‘সোনার মতো দামি’। কিন্তু আজ অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পরিকল্পিত উন্নয়ন ও সুরক্ষার অভাবে দ্বীপটি পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে। শীত মৌসুমেও যেখানে পর্যটকের ভিড় থাকার কথা, সেখানে এখন নেমে এসেছে নীরবতা।

একসময় বাতাসে মিশে থাকা লবণাক্ত সমুদ্রের ঘ্রাণ ও প্যারাবনের ছায়া আজ দগ্ধ গাছের গন্ধে ঢেকে গেছে। রাতের অন্ধকারে এক্সকাভেটরের শব্দ, আগুনের লেলিহান শিখা—সব মিলিয়ে পুড়ে গেছে হাজারো গাছ, মানুষের স্মৃতি আর ভবিষ্যৎ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় যে প্যারাবন শত মানুষের রক্ষাকবচ ছিল, সেটিই আজ নিজেই টিকে থাকার সংগ্রাম করছে।

সোনাদিয়ার ৪৯২৮ হেক্টরের দ্বীপে প্যারাবন ছিল প্রধান আকর্ষণ—সাদা বাইন, কালো বাইন, কেওড়া, নোনিয়া, হরগোজাসহ প্রায় ৩০ প্রজাতির উদ্ভিদে ভরপুর এই বন। স্থানীয়দের অভিযোগ, বছর ধরে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা চিংড়ি প্রকল্প ও লবণ মাঠ তৈরির নামে নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ কেটে ফেলছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত—সব রাজনৈতিক ঘরানার প্রভাবশালী মহলই এই দখলদারিতে যুক্ত বলে দাবি বাসিন্দাদের। প্রশাসনের চোখের সামনেই বন উজাড় হলেও কার্যকর ব্যবস্থা খুব কমই দেখা যায়।

চকরিয়ার পরিবেশকর্মী নুরুল আমিন জানান, “১৯৭৭ সাল থেকে বন ধ্বংস শুরু হয়েছে। এখন নেই বললেই চলে। বেশিরভাগ দখল হয়ে গেছে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ছত্রছায়ায়।” নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্টের কর্মকর্তা মো. আব্দুল কাইয়ুম জানান, বিগত কয়েক বছরে প্রায় ৩৫টি জায়গায় অবৈধ চিংড়ি ঘের তৈরির জন্য রাতদিন এক্সকাভেটর চালিয়ে লাখো গাছ কেটে এরপর পেট্রল ঢেলে পোড়ানো হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর কয়েকটি মামলা করলেও রাঘববোয়ালদের নাম থাকে না বলেও জানান তিনি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সোনাদিয়ার খাল-মোহনা-বনাঞ্চলে রয়েছে—১৯ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ৫০ প্রজাতির কাঁকড়া, ৮০ প্রজাতির সাদা মাছ, ৬৫ প্রজাতির স্থানীয় ও যাযাবর পাখি, তিন প্রজাতির ডলফিন, সামুদ্রিক কাছিম, মেছো বাঘ, শিয়াল এবং বহু প্রজাতির সরীসৃপ।

বর্তমানে দ্বীপটিতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা মাত্র ৮১০ জন; ভোটার ৩৮৪ জন। মৎস্য আহরণই প্রধান জীবিকা। শীত মৌসুমে উৎপাদিত শুঁটকি সারা দেশে জনপ্রিয় হওয়ায় একসময় পর্যটকের ভিড় থাকলেও এখন ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। শিক্ষার অবস্থা দুর্বল—মাত্র দুটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে; মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় অধিকাংশ শিশুর পড়াশোনা প্রাথমিকেই থেমে যায়।

পরিবেশবিদদের মতে, সোনাদিয়া পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হওয়ায় সেখানে বিশৃঙ্খল পর্যটন নয়, বরং কমিউনিটি-ভিত্তিক ইকো ট্যুরিজমই টেকসই সমাধান হতে পারে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা, বিকল্প কর্মসংস্থান এবং পরিবেশসম্মত অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে দ্বীপটি জাতীয় পর্যটনে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিতে পারে।

জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল মান্নান বলেন, “সোনাদিয়ায় বন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্যারাবন পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন উদ্যোগ চলছে।”

Post a Comment

0 Comments