১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর, বিকেলবেলা। কক্সবাজার পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে মুহূর্তেই জড়ো হয় হাজারো মানুষ—তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ, নারী, শিশু। শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। ঠিক তখনই উখিয়ার রত্নাপালং হাইস্কুল ক্যাম্প থেকে চারটি গাড়িবহর নিয়ে সমুদ্রতীরের শহরে প্রবেশ করে মুক্তিবাহিনীর দল। একটি খোলা জিপে দাঁড়িয়ে কমান্ডার আব্দুস সোবহান ঘোষণা দেন—“আজ থেকে কক্সবাজার মুক্ত।” মুহূর্তেই আকাশে উড়তে থাকে লাল-সবুজের পতাকা, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে উল্লাস আর মুক্তির উদ্দাম চিৎকার।
সেই ঐতিহাসিক বিকেলের স্মৃতি আজও গভীর আবেগে স্মরণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহমেদ। তিনি বলেন, “সে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। চারদিকে মানুষের যে আবেগ—বীর যোদ্ধাদের প্রতি যে সম্মান—এখনো চোখে ভাসে।”
তিনি জানান, পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা পরাজয়ের মুখে কক্সবাজার শহর ও গ্রামাঞ্চল ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে। ৭ ডিসেম্বর কমান্ডার সোবহানের নেতৃত্বে উখিয়া ও রামু মুক্ত হয়। এরপর ১২ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় রত্নাপালং হাইস্কুল ক্যাম্প থেকে চারটি বাসে মুক্তিবাহিনী কক্সবাজার শহরের উদ্দেশে রওনা দেয়। শহরে পৌঁছে তারা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন স্থানে অগ্রসর হয়।
মোজাফফর আহমেদ ছিলেন সেই দলে, যারা তৎকালীন জেলে পার্কের পাশের সার্কিট হাউজে প্রবেশ করেন। তিনি সেখানে দেখতে পান নারীদের ছেঁড়া পোশাক, দেয়ালে রক্তের ছোপ, আর সৈকতের দিকে অর্ধ-মাটি চাপা লাশ—কুকুরে টানাটানি করছে। হৃদয়বিদারক দৃশ্যের মধ্যে তিনি তুলে আনেন ছিটকে থাকা ১৭টি মানুষের খুলি—যা তিনি সার্কিট হাউজের দেয়ালে সারিবদ্ধভাবে রাখেন। স্মৃতি বলতে গিয়ে আজও তার চোখ ছলছল করে ওঠে। তিনি বলেন, “রক্তের স্রোতে লেখা নাম বাংলাদেশ; এ দেশ যেন পথ না হারায়।”
কক্সবাজার মুক্ত দিবস উপলক্ষে এ বছর কোনো আনুষ্ঠানিক আয়োজনের খবর পাওয়া যায়নি। তবে ইতিহাসে চিরদিন অম্লান থাকবে ১২ ডিসেম্বর—সেদিন সাগরতীরে যে মুক্তির জোয়ার উঠেছিল, তার পরিণতি চূড়ায় পৌঁছে ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয়ে।
0 Comments